একটি গ্রামকে বদলে দেয়া এক বীরের গল্প

মাসুক হৃদয় | ০১ মে ২০২০ | ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ
অ+ অ-

চল্লিশের দশকে যখন পুরো ধরখার ইউনিয়নে কোন উচ্চ বিদ্যালয় ছিলো না, তখন কসবার চারগাছ অখিল দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়, নবীনগরের বিটঘর রাধানাথ উচ্চ বিদ্যালয় ও আশুগঞ্জের তালশহর এ এ আই উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তেন তিনি।

প্রতিটি স্কুলই বাড়ি থেকে দুরবর্তী এলাকায় হওয়ায় ‘লজিং মাস্টার’ থাকতে হতো। ছুটি পেলে জমির আইল ধরে দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে বাড়ি আসতে হতো। সেই থেকে এলাকায় বিদ্যালয় না থাকার অভাব পীড়া দিতো তাকে।

মনের কোণে জমে থাকা এই পীড়া থেকেই তিনি নিজ গ্রামে গড়ে তুলেছেন একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এসব প্রতিষ্ঠানের কারণেই আমুল পরিবর্তিত হয়েছে একটি গ্রাম। এছাড়াও আশাপাশের একাধিক গ্রামের মানুষ শিক্ষার আলোতে আলোকিত হয়ে নিজেদের গ্রামকে এগিয়ে নিয়েছেন।

যে মানুষটির কারণে এমন পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে, তাঁর নাম সৈয়দ এমদাদুল বারী। বৃহত্তর কুমিল্লা বর্তমান ব্রাহ্মণবাডিয়া জেলার তদানীন্তন কসবা বর্তমানে আখাউড়া উপজেলার রাণীখার গ্রামের সম্ভ্রান্ত সৈয়দ পরিবারে ১৯৩৫ সালের ২৩ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন তিনি।

পুরুষাণুক্রমে মীর ইসরাক তথা সৈয়দ ইসরাক ইব্রাহিম আলী তথা সৈয়দ ফজলে আলী তথা সৈয়দ আলতাফ আলীর ঔরসজাত পুত্র সৈয়দ আব্দুল হান্নান তৎকালীন একজন ইংরেজী শিক্ষক। তার দ্বিতীয় সন্তান সৈয়দ এমদাদুল বারী। অত্যন্ত পরহেজগার হিসেবে এলাকায় স্বীকৃত তার মায়ের নাম সৈয়দা ফয়জুন্নেসা।

পিতা সৈয়দ আব্দুল হান্নানের সাহচর্যে শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি ঘটে এমদাদুল বারীর। তিনি নবীনগর উপজেলার বিটঘর রাধানাথ উচ্চ বিদ্যালয়, কসবার চারগাছ এ ডি উচ্চ বিদ্যালয় এবং আশুগঞ্জের তালশহর এ এ আই উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। চতুর্থ শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজী শিক্ষক পিতার নিবিড় সাহচর্যে  প্রথম স্থান অধিকারি ছাত্রের গৌরব অর্জন করেন। পরবর্তীতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের ঐহিত্যবাহী অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৫০ সালে তৎকালীন মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিসহ উত্তীর্ণ হন তিনি।

১৯৫৩ সালে কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার হাজী আসমত কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণি পেয়ে আই. এ পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়ে সলিমুল্লাহ মুসলিম (এস এম) হলে আবাসিক ছাত্র হিসেবে ছিলেন। পরবর্তীতে শারিরিক অসুস্থ্যতার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রি নিতে না পারায় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে সেখানকার পপুলার হোস্টেলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর প্রখ্যাত আইনবিদ ও সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম ড. কামাল হোসেনের সাহচর্যে আইন ডিগ্রি লাভ করেন।

আইন পেশায় কিছুকাল ঢাকায় প্র্যাকটিস করেন। সনদ বিধিমতে সেখান থেকে কুমিল্লা জজ কোর্টে বদলি হন। কুমিল্লায় কিছুকাল প্র্যাকটিস করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া তৎকালীন মহকুমা কোর্টে বর্তমানে সেশন কোর্টে ১৯৬৬ সালের ডিসেম্বর থেকে আইন পেশা শুরু করেন। তিনি দীর্ঘ ৪৫ বছর যাবৎ একাধারে আইন পেশায় সুনামের সাথে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি দুইবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবি সমিতির সভাপতি হিসেবে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বারসহ সকলে তৎকালীন গভর্ণর খুনি নুরুল আমিনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনরত সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পর তিনি বর্তমান কেন্দ্রেীয় শহীদ মিনারে যান এবং তৎকালীন সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ভাষার দাবিতে বক্তব্য দেন।

১৯৫৩ সালে এস এম হলের ছাত্র হিসেবে ১৯১,ওয়েষ্ট হাউজে বাসকালীন সময়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান হলে এসে তাকে পাকিস্তানের সামরিক জান্তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশগ্রহণের আহবান জানান। যার প্রেক্ষিতে তিনি আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং পিকেটিং করার সময় পুলিশের হাতে আটক হয়ে সদরঘাট জেল হাজতে প্রেরিত হন। তাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে জাতির জনক তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলে তাদের সেন্ট্রাল জেলে পাঠাতে বাধ্য হন।

১৯৬৫ সালে তিনি নিজ এলাকা তৎকালীন কসবা থানার ধরখার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ১১ দফা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন যা পরবর্তীতে ৬ দফা আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। ১৯৬৯ সালে কসবা থানার প্রতিটি ইউনিয়নে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ কমিটি গঠন করেন। ১৯৭০ সালে ৩৮ বছর বয়সে তিনি গণপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৭১ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের দক্ষিণ-পূর্ব রণাঙ্গনের প্রচার দপ্তরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে এবং ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার বিজনা ইয়ুথ ক্যাম্পের ক্যাম্প চীফ থেকে মুক্তিযুদ্ধাদের পলিটিক্যাল মোটিভেশন প্রদান করেন।  ট্রেনিংসহ অকুপেশন আর্মি পাঞ্জাবিদেরকে পুর্ব পাকিস্থান থেকে বিতাড়িত করার যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সম্মুখে অগ্রগামী করে সাধারণ জনতাকে সহযোগিতার মাধ্যমে নিজ জন্মভুমিতে প্রবেশে সহযোগিতা করেন।

স্বাধীনতার অর্জনের পর ১৯৭২ সালে নিজের রক্ত দিয়ে সংবিধানে স্বাক্ষর করে “Member of the Constituents Assemble of Bangladesh” এর সুনাম অর্জন করেন।  ১৯৭২ সালে তিনি কসবা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং পরপর দুইবার সভাপতি থাকার দুলর্ভ সম্মান লাভ করেন।

১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার তীব্র প্রতিবাদ জানানোর কারণে তিনি কারাবরণ করেন। ১৯৮০ সালের পর তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক নির্বাচিত হন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভুমিকা রাখার কারণে তিনি পরবর্তীতে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। জনগনের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে দীর্ঘ অবদান রাখার প্রেক্ষিতে ২০১০ সালের অক্টোবরে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন এবং বর্তমান কমিটি গঠনের আগ পর্যন্ত স্ব-পদে বহাল ছিলেন।

দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলনে ত্যাগ তিতিক্ষার অবদান স্বরূপ বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর তাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিষদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপর সে বছরের ২০ ডিসেম্বর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

একজন মহান হৃদয়ের মানুষ সৈয়দ এমদাদুল বারী তাঁর নিজ গ্রামকে মায়ের মতো ভালোবাসেন। এজন্য তিনি নিজ গ্রাম রাণীখারে একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও এতিমখানাসহ একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।

তিনি ১৯৫০ সালে রাণীখার গ্রামে একটি আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে  সৈয়দ এমদাদুল বারী গাউছিয়া আলিম মাদ্রাসা নামে নামকরণ করা হয়। বর্তমানে তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।

১৯৭০ সালে তিনি আল-আমিন গাউছিয়া এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন যাহা আখাউড়া উপজেলার মধ্যে একমাত্র রেজিস্ট্রার্ড এতিমখানা ।

১৯৭৩ সালে গর্ভধারিণী মায়ের সম্মানে ফয়েজুন্নেসা পল্লী স্বাস্থ্য কেন্দ্র নামে একটি হাসাপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। যার মাধ্যমে তাঁর গ্রাম তথা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের মানুষ বিনামূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসা সেবার সুযোগ পান।

১৯৭২ সালে তিনি বাবার সম্মানার্থে ও স্মৃতিতে গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘রাণীখার এস. এ. হান্নান মাধ্যমিক ও কারিগরি উচ্চবিদ্যালয়। একই সালে রাণীখার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

গত ২০০০ সালে রাণীখার জামে মসজিদ দ্বিতল ভবনে রুপান্তর করাসহ কসবা আখাউড়ায় বহু মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণে সহায়তা করেন।

এছাড়া এই মানুষটির উদ্যোগে নির্মিত হয় কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের ধরখার বাসষ্ট্যান্ড থেকে পশ্চিম দিকে ধরখার-রুটি সড়ক। এখন এ সড়কটি কসবার মূলগ্রাম ইউনিয়নের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়ে নবীনগর পর্যন্ত গেছে। তিনি ধরখার বাসষ্ট্যান্ড থেকে পূর্বদিকে মোগড়া বাজার পর্যন্ত সড়ক নির্মাণেও ভূমিকা রাখেন।

গ্রামের বাইরেও তিনি এলাকার শিক্ষা প্রসারে প্রায় ৫০ টিরও বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মানে প্রত্যক্ষ সহায়তা করেন।

জেলা পরিষদে দায়িত্ব নেয়ার তিনি গ্রামের অলিগলিতে সড়ক নির্মাণসহ কবরস্থান উন্নয়ন ও বহু ঘাটলা নির্মাণ করেন।

এবার জানাবো মহান এই মানুষটির পারিবারিক জীবনের কথা। পারিবারিক জীবনে তিনি তিন কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের জনক।

তার প্রয়াত স্ত্রী মিসেস সুফিয়া বারী ছিলেন সাবেক এসডিও মরহুম দরবার আলীর মেয়ে। তিনি ঢাকার লালমাটিয়া গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। বর্তমানে সৈয়দ এমদাদুল বারী ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের গোকর্ণ রোড সংলগ্ন কাজীপাড়া এলাকার ৭৫৫ নং বাসভবন ক্ষণিকা ভবনে বসবাস করছেন। তার বড় সন্তান সৈয়দা শাহানা বারী ওরফে নাসরিন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা বর্তমানে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

তাঁর দ্বিতীয় কন্যা সৈয়দা জাকিয়া বারী সিঙ্গাপুরের একটি কলেজে অধ্যাপনা করছেন। তিনি স্বামী বুয়েটের প্রকৌশলী রুহুল আমিন সরকারের সঙ্গে সিঙ্গাপুরে বসবাস করছেন।

তাঁর তৃতীয় কন্যা সৈয়দা রেজিনা বারীর স্বামী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আনোয়ার শফিক এনডিসি-পিএসসি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই কর্মকর্তা বর্তমানে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) এর ইন্সপেক্টর জেনারেল হিসেবে কর্মরত আছেন।

তাঁর বড় ছেলে সৈয়দ এহতেশামুল বারী ওরফে তানজিল বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক। এছাড়া তিনি ইউনিভার্সিটি অব ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ট্রাস্টি ও ঢাকাস্থ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক।

তাঁর ছোট ছেলে আইনজীবি সৈয়দ ইখতেয়ারুল বারী ওরফে তানবির বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা জজ আদালতের সহকারি পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি)। এছাড়া তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ি।

লেখক : মাসুক হৃদয়, দ্য ডেইলি স্টার-এর প্রতিবেদক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। 

Facebook Comments

পড়া হয়েছে 3819 বার
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
x